Wednesday, July 30, 2014

ভিসকি গোলি

টিভিটা ছিল চারপেয়ে। আর সামনে একটা শাটার যেটা দুদিকে খুলে যেত। তারপর নব ঘুরিয়ে চালু হত টিভি। আপট্রন। টিভিতে অ্যাড চললে নিথর হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়তাম। তখন অবশ্য অ্যাড বলা হত না, অ্যাভার্টাইসমেন্ট বলা হত। দুটো বিজ্ঞাপন ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় - 'নিরমা' আর 'ভিক্স'। এই দুটো জিঙ্গল গেয়ে দালান, উঠোন, বাগানে ঘুরে বেড়িয়েছি ঢের। নিরমার বিজ্ঞাপন টা আমি আর দিদিয়া অভিনয় করে সকলকে দেখাতেও পারতাম। ও ঘুরে ঘুরে দাঁড়াত আর আমি হামাগুড়ি দিয়ে ওর দু'পায়ের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতাম 'ওয়াশিং পাউডার নিরমা' গাইতে গাইতে। বলাই বাহুল্য অভিনয়ের শেষে জোর করে হাততালিও জোগাড় করতাম।

আর ভিক্স এর বিজ্ঞাপনটায় তখন ছিল বাবা আর মেয়ে। বাবার পিঠে চড়ে মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘুরতে ঘুরতে বাবার গলা খুসখুস। অতঃপর আমিও বাবাকে ঘোড়া করে চড়ে বসতাম পিঠে। আর গলা ফাটিয়ে "ভিসকি গোলি লো খিচখিচ দুত কালো..." বলে ঘুরে বেড়াতাম একবার, দুবার, তিনবার, যতক্ষণ না বাবা 'আর নয়' বলছে।

ভিক্সটা এখনও মাঝেসাঝে খেতে বেশ ভালোই লাগে। বাবাকে অবশ্য দিই না। শুয়ে শুয়ে কি আর লজেন্স খাওয়া যায়?

Tuesday, July 29, 2014

সুকুমার সমগ্র

আমার ছ' বছরের জন্মদিনে বাবা একটা সুকুমার সমগ্র কিনে দিয়েছিল। মোটাসোটা শক্ত রংচঙে মলাট আর তার ওপর মস্ত অক্ষরে বই এর নাম। ততদিনে 'সুকুমার সমগ্র' কথাটা পড়তে পারি। মনে আছে বইটা হাতে পেয়ে প্রথমেই জিগ্যেস করেছিলাম, "সমগ্র মানে কি?" বাবা বলেছিল 'সব'। সত্যি কথা বলতে কি, বইটা হাতে পেয়ে খানিকটা গর্ব বোধ হলেও (অত মোটা বই পাওয়ায়) খুব যে উৎফুল্ল হয়েছিলাম এমন কিন্তু নয়। কারণ তখনও বই পড়ার অভ্যেস আমার তৈরি হয়নি। বই শোনার অভ্যেসটাই আমার সঙ্গে কল্পলোকের যোগসূত্র। বই শুনতাম ঠাকুমার কাছে রোজ রাতে শোবার আগে। 'সেভেন ইন্ডিয়ান ক্লাসিকস' থেকে বত্রিশ সিংহাসন, জাতকের গল্প, বেতাল পঞ্চবিংশতি, এইসব। তবে ছ' বছরের জন্মদিন আসার কয়েকমাস আগেই ঠাকুমা একদিন বাবা কাকা জেঠুদের কাঁধে চড়ে বেরিয়ে গেছেন। আর ফেরেননি।

অতএব সুকুমার সমগ্র পড়ে শোনানোর দায়িত্ব বাবার চওড়া কাঁধেই বর্তায়। সেবার পুজোয় যখন তিন ভাইবোন (আমি, ভাইয়া, দিদিয়া) একত্র হয়েছি আর তিনজনকে দুপুরে ঘুম পাড়ানোই সবচেয়ে দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাবা মাঠে নামলো, হাতে সুকুমার সমগ্র। ভারী গলায় পড়তে শুরু করল -

"বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের উপর রুমালটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্যে যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল "ম্যাও!" কি আপদ রুমালটা ম্যাও করে কেন?"

ব্যাস। তারপর থেকে দুপুরে বিছানায় যাওয়া নিয়ে কোনো বিদ্রোহ, হইচই কিচ্ছু নেই। খাওয়াদাওয়া সেরে নিজেরাই গুটিগুটি বিছানার পানে হাঁটা লাগাই, একবার বাবাকে তলব করে। আমার মনে আছে, ঐ সাজিমাটি আর কুলপি বরফের জায়গাটায় আমরা এক্কেবারে হিজি বিজ বিজ-এর স্টাইলেই হেসে কুটপাটি হয়েছিলাম। পুজোর ছুটির শেষ হবার পর, দিদিয়া-ভাইয়ারা চলে যাওয়ার পরেও অনেকগুলো রবিবার বাবার গলায় পাগলা দাশু্র সব গল্প, হিংসুটে, অবাক জলপান, শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি।

সুকুমার সমগ্র'টা পঁচিশ বছরের অত্যাচারে অনেকটাই জীর্ণ। এখন খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয়। তবুও মাঝেসাঝেই নামিয়ে ফেলি তাক থেকে। তবে সেটা শুধুই সুকুমার রায়'এর মোহে নয়। তার কারণ এই একটাই মাত্র উপহারে বাবাকে আমি যে নামে ডাকি আর বাবা আমাকে যে নামে ডাকে, তার উল্লেখ আছে। বইটার প্রথম পাতায় বাবার হাতে লাল কালিতে লেখা একটা ছড়া-

"লক্ষীসোনা মারেম আমার
বয়স হলো ছয়
ভর্তি হলো ক্লাস ওয়ান এ
আর দেরী না সয়
মনটি দিয়ে লেখাপড়া
করতে হবে জেনো,
ভালোবাসবে সবাই তোমায়
কথা যদি শোনো।"
 - বাম্পি




Monday, July 28, 2014

তর্জনীর পৃথিবী

বাবার হাতটা খুব বড় ছিল। পুরো হাতটা ধরতে পারতাম না বলে, রাস্তায় বেরোবার সময় বাবা বাঁ হাতের তর্জনীটা বাড়িয়ে দিত। আর আমি সর্বশক্তি দিয়ে আমার ডান হাতের মুঠোয় চেপে ধরে রাখতাম ঐ একটা আঙুল। বাদামী রঙের, চওড়া, একটু খসখসে একটা আঙুল। পাড়ার গলিতে, পুরির সমুদ্রের ধারে, লীডার নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাবার সময়, স্কুল বাসে ওঠার ঠিক আগের মুহুর্ত পর্যন্ত ঐ একটা আঙুল ধরেই সবচেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করেছি। মাইলের পর মাইল বছরের পর বছর। বাবা হাত ভাঁজ করলে বাইসেপ টা ফুলে উঠত। আর আমরা তখন বাবার হাতটা টিপে টিপে দেখতাম। লোহার মত শক্ত লাগত। ওয়েট লিফটিং করত তো, তাই গায়ে জোর ছিল ঢের। বাবার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি দেদার। অত উঁচু থেকে সবকিছু খুব নিচু লাগত। ভয়ও করত। বাবার মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে থাকতাম। রামেস্বরমের মন্দিরের লাইনে দাঁড়িয়ে আমাকে তুলে উঁচু করে ধরেছিল যাতে বিগ্রহটা দেখতে পাই। দূরপাল্লার ট্রেনের ওপরের বার্থে উঠতে চাইলে এক ঝটকায় তুলে ওপরে বসিয়ে দিত। এক হাতে হোল্ডল, অন্য হাতে সুটকেস নিয়ে বাবা সবার আগে আর আমরা পেছনে পেছনে ছুটতাম ট্রেন ধরার সময়। লোকাল ট্রেনেও নাগালের বাইরের ঐ হ্যান্ডরেলেগুলো ছোঁবার আগ্রহ ছিল অসীম। ট্রেন ফাঁকা হয়ে এলেই তাই বাবার হাতে টান মেরে আঙুল দিয়ে ইশারায় টুক করে ইচ্ছেটা বুঝিয়ে দিতাম। আমাদের ষ্টেশন আসার আগেই ইচ্ছাপূরণ। তখন আর বড়দের সঙ্গে আমার কোনো ফারাক নেই। সবার মতো আমিও হ্যন্ডরেলে ভর। আর যেকোনো উঁচু জায়গা দেখলেই সেখানে উঠতে চাইতাম আর তারপরেই ওয়ান, টু, থ্রি...বলে ঝাঁপ; আর প্রত্যেকবার একইরকম তৎপরতায় বাবা খপ করে লুফে নিতেই বায়না - "আর একবার।"

এখন বাবার হাতটা খুব সরু হয়ে গেছে। আমার চেয়ে সরু। ইনজেকশন দিতে এসে কম্পাউন্ডার মাংস খুঁজে পায় না। এখন আমি গোটা হাতটাই ধরতে পারি অনায়াসে। নিজেরটা বাড়িয়ে দিই, যাতে সহজে উঠতে পারে বিছানা থেকে। এখনও শুয়ে থাকতে থাকতে নিজের হাতটা দ্যাখে বাবা মাঝে মাঝে। একদিন বললো "মাঝে মাঝে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করে। আমারই হাত তো?"