Friday, December 19, 2014

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে...

পিঁক পিঁক পিঁক  করে যন্ত্রগুলো বেজে চলেছে ফিল্মি উদ্যমে। একগাদা ডিজিটাল মিটার আর তাতে অনেকগুলো সংখ্যা। কিছু সংখ্যার মানে বুঝি, কিছু গ্রিক। একটা মেশিনের মিটার তোমার 'রেস্পিরেশান' মাপছে। সেটায় মিটার ২১, ২০, ১৯ হতে হতে এখন ১৪ এ ঠেকেছে। আমি জানি ওটা আর বাড়বে না। কমতে কমতে এক সময়ে থেমে যাবে। হাসপাতালের এইচ ডি ওয়ার্ডের এসি টা বেশ জোর চলছে। তোমার গা খুব ঠান্ডা হয়ে গেছে। তোমার ডান হাতের তর্জনীটাও। আমি জানি তোমার চোখ খোলা হলেও তুমি আর আমাকে দেখতে পাচ্ছ না। তবুও তোমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দি। একবার ডাকি। বলা তো যায় না, যদি শুনতে পাও...যদি সাড়া দাও! সাড়া দাও না তুমি। দৃষ্টিহীন চোখে সামনের দেওয়ালের দিকে চেয়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকো ধীরে। আরো ধীরে। বুঝতে পারো না, সর্বশক্তি দিয়ে ধরে আছি তোমার ডান হাতের তর্জনীটা - যেটা ধরে এযাবৎকাল কাটিয়েছি। বুঝতে পারো না, তোমার বুকের ওঠাপড়ার দিকে কি অসীম আগ্রহে তাকিয়ে আছি। যন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এক সময় থেমে যাও। ঠান্ডা ঘরটায় তখন শুধু তুমি আর আমি। লড়াই শেষ করে নিশ্চিন্ত ঘুমের আশ্রয়ে তুমি। আর লড়াই শুরুর প্রস্তুতিপর্বে আমি।এক হাতে তোমার হাতটা ধরে থেকে অন্য হাতে তোমার চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে যখন তাকিয়ে আছি দুটো বন্ধ পলক আর অল্প ফাঁক হওয়া ঠোঁটের দিকে, হঠাৎ সেই গানটা মনে গেল, যেটা তুমি লোডশেডিং হলে গাইতে। সেই দুটো লাইন মনে মনে গুনগুন করতে থাকলাম - 

"জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর লোক-লোকান্তরে যুগ-যুগান্তর–
 তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে।"

তর্জনীর আশ্রয় ছেড়ে বেরলাম। সবাইকে খবরটা দিতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, কারুর হাত না ধরেই আমি দিব্যি চলতে পারি...।

Thursday, December 18, 2014

বড়দিন

ছোটবেলায় মিশনারি স্কুলে পড়তাম। তাই শীতের ছুটিটা হত লম্বা। তখন আমরা বেড়াতে যেতাম। কিন্তু বেড়াতে গিয়েও বড়দিনের দিনটায় ঘোরার সঙ্গেই জুড়ে যেত একটূ স্পেশাল খাওয়াদাওয়া। বেড়ানোর ডেস্টিনেশন কোনো শহর হলে, খুঁজেপেতে একটা কেক কিনে আনা হত। না পেলে, অন্য কোনো স্পেশাল মেনু। একবার বড়দিনের আমরা মাউন্ট আবু তে ছিলাম। হোটেলের বারান্দায় রোদে পিঠ ঠেকিয়ে জমিয়ে মাংস ভাত খাওয়া হয়েছিল মনে আছে। আর একবার ছিলাম কৌসানি তে। সেবার অবশ্য গান্ধী আশ্রমের ভেতরে থাকার কারণে আলাদা করে কোনো কেক টেকের ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে সন্ধ্যেবেলা ঘরের মধ্যে কম্বলে গলা অব্দি ঢেকে গানের লড়াই খেলেছিলাম জমিয়ে। তারপর খাওয়ার ঘন্টা পড়লে গনগনে আগুনের আঁচে বসে গরম গরম ডাল রুটি সব্জি - আমার মত কট্টর আমিষাশীর কাছেও সেই খাবার ছিল অমৃত।

আর ছিল গ্রিটিং কার্ডের হুজুগ। স্কুলের গেটের বাইরে একটা লোক এক টাকা, দু টাকা, পাঁচ টাকার কার্ড নিয়ে বসত। আর থাকত সোনালী ছোট ছোট ঘন্টা, চকচকে রঙিন বল, নানারকমের রিবন, ছোট্ট সান্টা কলস...ক্রিস্টমাস ট্রি সাজাবার উপকরণ্লস্মায়ের কাছে পয়সা চেয়ে নিয়ে কার্ড কিনতাম। হিসেব করে। যার যার থেকে কার্ড পাবার আশা ছিল তাদের প্রত্যেকেই যাতে প্রয়োজনে রিটার্ন কার্ড দিতে পারি, হিসেবে যেন গন্ডগোল না হয়, সে ব্যপারে সতর্ক থাকতে হত। ছুটি পড়ার দিন আর ইউনিফর্ম নয়। রঙিন জামা পরে স্কুলে যাওয়া হত। ক্যারল গাইত গানের দল। আর মিত্র স্যার সান্টা সেজে ঝুলিতে লজেন্স ভরে হলের ভেতরে ঘুরতেন। মাঝে মাঝে থলিতে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠো  লজেন্স তুলে এনে ছুঁড়ে দিতেন আমাদের মধ্যে হরির লুটের কায়দায়। সকলে ওমনি হামলে পড়তাম একটা বয়েজের অরেঞ্জ লজেন্স পাব বলে।

এখন তো কত বড় হয়ে গেছি, তাও ঐ ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখটা এলেই এক টুকরো প্লাম কেকের জন্য ফ্লুরিজ কি ক্যাথলিন কি মনজিনিস দৌড়ই। মনের মধ্যে ফরফর করে প্রজাপতি উড়তে থাকে। খালি মনে হয় কি যেন একটা করা উচিৎ। কিছু একটা না করলেই নয়। যীশুবাবার জন্মদিন বলে নয়, একটা গোটা শৈশব কৈশোরের অভ্যেস ধরে রাখব বলেই বোধহয়। আর পার্ক স্ট্রীটের বাৎসরিক আলোর মান রাখব বলে।

সেইসব পুরনো উলের গন্ধ

মনখারাপ বা বিষাদের কাছে মুখ রক্ষা করার দায় যাদের নেই, তারা শীতকাল পড়তে সহজেই তোরঙ্গ খোলে। বের করে ন্যাপথালিনের গন্ধ মাখা টুপি, মাফলার, শাল, যা আর কোনোদিন ব্যবহার হবে না, হবার নয়। ছাদে উঠে নিয়মমাফিক রোদে দেয় কাঁথা, লেপ, বালাপোশ। রাত পড়লে, বিছানার অন্য পাশটা খালি জেনেই, গোড়ালিতে ভেসলিন মেখে ঘুম দেয় রোদগন্ধ মাখা ঈষৎ গরম তুলোর আরামে। বন্ধ দরজা জানালার ওপাশে শীতের শুকনো হাওয়া তবুও খুব মাঝেসাঝে মাঝরাতে কাচ ঝনঝনিয়ে জানান দিয়ে যায়, বার্নিং ঘাটে যাদের রেখে আসা হয়, তারা আর ফেরে না। উত্তাপের প্রয়োজন তাদের ফুরিয়েছে।

দুর্গাপুজোর আগে

চার পেগ নির্ভেজাল ভদকা পাকস্থলিতে নিয়ে টলোমলো পায়ে মেট্রোয় উঠলো মেয়েটা| সুরেলা মেয়েলি গলা পরের স্টেশনের নাম জানিয়ে দেবার পরেই হঠাত মেট্রোর লাউডস্পিকারে গমগম করে উঠলো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলার চন্ডিপাঠ| সুপ্রীতি ঘোষের গলা গেয়ে উঠলো বা-আ-আ-জ-লো-ও-ও তো-ও-ও-মা-আ-আ-আ-র আ-আ-আ-লো-র বেণু| মেট্রোর ভিড়, ঠেলাঠেলি ছাপিয়ে মনে পড়ে গেল মার্ফি রেডিও, নীল নাইলনের মশারি, কাকভোরে চায়ের কাপে চামচের টুংটাং আর বাবার হাতের ঠেলা "ওঠো ওঠো!" 

এই সামান্য প্ররোচনায় যে সব এত সহজে মনে পড়ে যাবে ভাবেনি শক্তপোক্ত মেয়েটা| ভেবেছিল যন্ত্রনারা ডুবে যায় কাঁচের গেলাসে, মাটির মালসা যেমন ডোবে গঙ্গায়| 

এক ট্রেন রঙিন লোকের মাঝে হঠাত কান্না পেলো সাধারণ মেয়েটার| নাক মুখ লাল করে দম চেপে ঢোঁক গেলে বানভাসি মেয়ে| মেট্রোর স্পিকারে চন্ডিপাঠ করতে করতে গলা ভেঙ্গে আসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের| 

Monday, December 1, 2014

গল্প নয়

সেপ্টেম্বরের রোদ্দুর এই সকাল দশটাতেই চামড়ায় তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সামনে ভাঁটার গঙ্গায় ঘোলাটে স্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে কচুরি পানা, প্লাস্টিক, ধূপের প্যাকেট, গাঁদা ফুলের মালা। বাঁশের জেটিটা পাড় থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে জলে মিশেছে। ভাঁটার জল আস্তে আস্তে জলে ডুবে থাকা জেটির অংশ ছেড়ে ছেড়ে নামছে। বাঁশের গায়ে লেগে থাকা ভিজে শ্যাওলা রোদ পড়ে ভেলভেটের মত দেখাচ্ছে। ঠিক যেরকম ভেলভেটের লম্বা হাতা ব্লাউজের ছেঁড়াখোঁড়া দেহাবশেষ মা এখনো যত্নে তুলে রেখেছে আলমারিতে। ব্লাউজটা দিদুর ছিল। মা এখন কি করছে কে জানে। কাঁদছে হয়ত। সকালের ওষুধগুলো আজ আর পড়বে না। ইনসুলিনটাও। দুপুরে খাওয়ার আগে দিয়ে দিতে হবে মনে করে। কি জানি কি খেতে দেবে আজ ওরা মাকে। পেছনে চুল্লির ঘর্ঘর ঘর্ঘর শব্দটা একঘেয়ে হয়ে চলেছে, হয়েই চলেছে। অনেক লোকজন এসেছে। এখন ওদিকটায় যেতে ইচ্ছে করছে না। এখানেও অবশ্য কেউ না কেউ শিগগিরই এসে পড়বে। একা থাকতে দিতে চাইছে না কেউ। ভাবছে কিছু করে ফেলি যদি? ভাবছে কি? না বোধহয়। ওরা তো জানে, আমি খুব শক্ত মেয়ে। কাঁদি টাঁদি না চট করে। জানে ওরা। তবুও সঙ্গ দিতে আসে। কাঁধে হাত রাখে। রাখুক। জেটির শেষে জলে পা ডুবিয়ে বসতে পেলে ভালো লাগত। কিন্তু সে হবার নয়।

ঢং ঢং ঢং ঢং করে ঘন্টাটা বেজে উঠলো। যেতে হবে এবার। শেষের শেষটুকু হবার ঘণ্টা।


চুল্লির কোলাপ্সিবল গেটটা খুলে দিয়েছে এবার। একটা লোহার চৌকো ট্রে দুজনে দুদিকে দুটো দড়ি বেঁধে ধরে নামিয়ে আনল। তাতে কয়েক টুকরো আগুন মাখা কালচে হলুদ ছাই পড়ে। ট্রে টা ধরে গঙ্গায় ডুবিয়ে দিয়ে মাটির কলসি ভরে জল তুলে আনতে বলল ওরা। গঙ্গার জলে গরম ট্রে টা ডোবাতেই ছ্যাঁক করে শব্দ করল। সেই যেমন কালীপূজোর দিন রাতে ফুলঝুরিগুলো জ্বলে যাবার পর উঠোনের এক কোণে অল্প জল ভরে রাখা টিনের বালতিতে ফেললে শব্দ হত। বাজি ফাটানো শুরু হবার আগেই বাবা বালতিটা রেখে দিয়ে বলে দিত আমাদের পোড়া বাজি ওতেই ফেলতে হবে। কালো ছাইগুলো ভেসে গেল। উঠে দাঁড়িয়ে ভাইয়ার চোখে চোখ রেখে হেসে বললাম – "Dust thou art and unto dust shalt thou return." 

Wednesday, October 29, 2014

দালোয়ান গায় গান শোনো ঐ লামা হই

এক বন্ধুর লেখায় কাল লাল পোস্টবক্স-এর কথা,  স্মৃতিগুলো সব উসকে দিল। লাল রংটা না, কেমন যেন। রাজনীতি নয়, স্মৃতির রং। লাল বললে পুরনো বাড়ির মেঝের কথা মনে পড়ে। চকচকে লাল ঠান্ডা মেঝে, যেখানে গরমকালের দুপুরে শুয়ে থাকতাম হাত পা ছড়িয়ে। যেখানে বাবা অফিস থেকে ফিরে গা ধুয়ে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে লম্বা হত, আর আমি বাবার পেটের ওপর বসে বকবকম করতাম।

নীল ষষ্ঠী, আশোক ষষ্ঠী, দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর আগে মা কাকিমা জেঠিমারা পা বাড়িয়ে বসে থাকত। আঙ্গুর পিসি পুরনো টুথব্রাশ দিয়ে আলতা পরিয়ে দিত ওদের পায়ে। বুড়ো আঙুলের পাশ দিয়ে নামত সরু লাল দাগটা, গোড়ালির কাছটা মোটা হয়ে ঘুরে গিয়ে আবার সরু হয়ে কড়ে আঙুল ছুঁয়ে, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে লাল রং করে দিত ব্রাশটা। উবু হয়ে বসে মন দিয়ে দেখতাম সেই ব্রাশের খেলা। আরেকদিন ঠাকুমার পায়ে কে যেন আলতা পরিয়েছিল। পায়ের চারপাশে নয়। গোটা পায়ে। তারপর একটা সাদা কাগজ চেপে ধরেছিল আলতামাখা পায়ে। কাগজে কি সুন্দর দুটো পায়ের ছাপ পড়ে গিয়েছিল। বাবা আমাকে কাগজের ওপর দাঁড় করিয়ে যেমন পেন্সিল দিয়ে পায়ের ছাপ এঁকে নিয়ে জুতোর দোকানে যেত, তেমনই। ঠাকুমার পায়ের সেই লাল ছাপ আজও ফ্রেমে বন্দি পুরনো বাড়ির দেওয়ালে।

ভাইয়াকে বাবা একটা প্লাস্টিকের গদা কিনে দিয়েছিল। সেটাও ছিল লাল রঙের। ওটা ঘাড়ে নিয়েই ও খাট, টুল, সিঁড়ি, রক থেকে ঝাঁপ দিত 'জয় শ্রী রাম' বলে। আর ছিল লাল আমার টোবু ট্রাইসাইকেলের সিট। সেই টোবু সাইকেল যাতে আমরা দুজন এমনকি তিনজনে মিলেও চেপে ঘুরে বেরিয়েছি ভাইয়াদের বিশাল জুটমিল কোয়ার্টারে। উত্তরাধিকার সূত্রে ও আমার কাছ থেকে পেয়েছিল সাইকেলটা। তারপর কার কাছে গেছিল ওটা, এখন আর তা মনে নেই। গান ছিল, ছড়াও ছিল টুকটুকে - "রবিমামা দেয় হামা গায়ে লাল জামা ঐ, দালোয়ান গায় গান শোনো ঐ লামা হই"। প্রথম কেনা কেলভিনেটর ফ্রিজ আর হারকিউলিস ক্যাপটেন লেডিস সাইকেলটাও কিকরে যেন সেই লাল রঙেরই কেনা হয়েছিল। আর হ্যাঁ, মায়ের শিল্পা টিপের পাতার প্রত্যেকটা টিপও ছিল টকটকে লাল।

এখন অবশ্য মা আর আলতা পরে না। কাকিমাও না।


Tuesday, October 21, 2014

প্রাক-ধনতেরাস যুগের সাদাকালো কথা



আজকে সেই প্রাক-ধনতেরাস যুগের কথা বলব, যখন বাঙালী কালীপূজো বলতে শুধু বাজি পোড়ানোই জানত। বাজির জমকও ছিল কম। ফুলঝুরি, রংমশাল, তুবড়ি, চরকি, হাউই, ছুঁচো বাজি, দোদোমা কালিপটকা, সাপবাজিই ছিল সম্বল। সোনার গয়না, রুপোর টাকা, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ইত্যাদির কোনও ভূমিকা ছিল না। 

কালীপুজোর আগের কটা দিন মহা ব্যস্ততায় কাটত। বাবার সুপারভিশানে ছাদে খবরের কাগজ পেতে লাইন দিয়ে রোদে দেওয়া হত গোটা কুড়ি রংমশাল, পাঁচ-ছ প্যাকেট ফুলঝুরি, গোটা দশেক চরকি, তার বাজি, সাপবাজি, ব্যস। আর একটু বড় হতে তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল কালিপটকা আর বুড়িমার চকোলেট বোম। তবে কিনা বাজি রোদে দেওয়া তো আর সহজ কাজ নয়! রোদে দিয়ে রেগুলার ইন্টারভ্যালে সেগুলোকে উল্টে পাল্টে দিয়ে আসতে হবে। আর সেই সুযোগে বারবার বাজিগুলো হাতে নাড়াচাড়া করা যাবে আর মিলিয়ে নেওয়া যাবে স্টক। এই স্টক মেলানোর ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি, কারণ বাজি পোড়ানোর সময় কেউ এক্সট্রা বাজি ফাটিয়ে ফেললো কিনা, সেদিকে কড়া নজর রাখা দরকার। আর সেই জন্যেই স্টক মুখস্থ করা।
বাড়ির দোতলার বারান্দার বেশ খানিকটা অংশে তখন ছোটদের প্রবেশ নিষেধ, কারণ সেখানে আমাদের জ্যাঠতুতো দাদার কর্মযজ্ঞ চলছে। লোহাচুর, অ্যালুমিনিয়াম গুঁড়ো, গন্ধক, তুবড়ির খোল, রংমশালের খোল সার দিয়ে রাখা। রান্নাঘর থেকে শিলনোড়া হাইজ্যাক করায় একচোট হুলুস্থুল সকালে হয়ে গেছে। জিরে, আদা, রসূনের বদলে এখন তাতে গন্ধক বাটার কাজ চলছে। কাজ মিটে গেলে শিলনোড়া যারা ব্যবহার করে তাদের মধ্যেই একজনকে দায়িত্ব নিয়ে ওটা পরিস্কার করে পুরনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নাওয়া খাওয়া ভুলে তখন দাদার ওয়ার্কশপ চলছে। তুবড়ির উচ্চতাই পাড়ার মাঠে প্রেস্টিজ নির্ধারক মাপকাঠি। সবমিলিয়ে বাড়ির বাতাসে তখন বারুদের তুমুল গন্ধ। 

কালীপুজোর আগের দিন অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীর দিন সকালে চোদ্দ শাক খাওয়া আর রাতে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালা ছিল রুটিন। একটা থালায় চোদ্দটা ছোট ছোট মাটির প্রদীপ সর্ষের তেল, সলতে দিয়ে জ্বেলে বাড়ির বিভিন্ন কোণে বসিয়ে দিত মা বা কাকিমা, ভূত তাড়াতে। পরে বড় হয়ে অবশ্য মনে হয়েছে যে ও নেহাতই অর্থহীন একটা নিয়ম। যে বাড়িতে কাক চিল পড়ার অবস্থা ছিল না, সে বাড়িতে ভূত আসবে কোন সাহসে?
কালীপূজোর দিন সন্ধ্যেয় আসল পরীক্ষা। এক নম্বর পরীক্ষা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। বারান্দার আলসেয় সরু সরু মোমবাতির পেছনে আগুন দিয়ে বসানো তো হল। কিন্তু লাইনের শেষে পৌঁছতে না পৌঁছতেই শুরুর মোমবাতি নিবে যায়। আবার সেগুলো জ্বালাতে গেলে বাকিগুলো গন। শেষে হাল এবং কণ্ঠ দুইই ছেড়ে বাজি পোড়ানোয় মনোনিবেশ এবং যবনিকা পতন। 

এখনকার কালিপুজো-গুলোর জাঁক অনেক বেশি। 'মেড ইন চায়নার' আলোয় ছাদ-বারান্দা ঝলমলায়। অনেকরকমের বাজি আসে। আকাশে সাঁই করে উঠে গিয়ে মস্ত বড় ফুল হয়ে ঝরে পড়ে পাঁচশো টাকার নোট। প্যারাশ্যুট নামে, আলোর মালা ভাসে আকাশে। কিন্তু আর যাই হোক দোকানের কেনা তুবড়ি দাদার তুবড়িকে টেক্কা দিতে পারে না আজও। ফুস করে জ্বলে উঠে নিবে যায়। 

আর কেন জানিনা, ভাইবোনেরা সেই ছোটবেলার ফুলঝুরি চরকির গল্পেই ঘুরেফিরে চলে আসি বারবার। দাদার হাতে রংমশাল ফেটে যাওয়ার গল্পে, কাকার পেছনে চরকি তাড়া করার গল্পে, দাঁত পড়ে রসগোল্লায় গেঁথে যাওয়ার গল্পে। বারুদের গন্ধমাখা লালনীল আলোয় বোধহয় মাদকতা আছে।   


পুনশ্চঃ তখন বারুদের গন্ধ বললে বাজি পোড়ানোর কথাই মাথায় আসত।

Tuesday, October 14, 2014

আমার গানের স্বরলিপি

এক একটা গানের গায়ে এক একটা নাম লেখা থাকে। সময় লেখা থাকে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন লেখা থাকে। এক একটা গান যেন টাইম মেশিনের এক একটা চাকা। ওদের গায়ে ভ্যাপসা গন্ধ হয় না। পোকায় কাটে না। ভাঁজ পড়ে না অবাঞ্ছিত।

মাখনের মতো হেমন্তের গলায় 'কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো রূপকথা নয় সে নয়...' শুনলেই আজও সেই লাল মেঝে, কালো বাক্সের মতো ন্যাশনাল প্যানাসনিক টেপ রেকর্ডার, কালো কাঠের আলনা, কড়িকাঠ, কুলুঙ্গি এসব মনে পড়ে যায়। টেপ জড়িয়ে গেলে আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছাড়ানো মনে পড়ে, লোডশেডিং হলে রকে বসে বাবার গলার 'রানার ছুটেছে খবরের বোঝা হাতে রানার রানার চলেছে রানার' মনে পড়ে। অন্ধকার পাইনের বনের ধারে দাঁড়িয়ে বলা "বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা টা একবার গাও না প্লিজ" মনে পড়ে। স্থায়ী অন্তরা গুলিয়ে যাওয়া মনে পড়ে। 'আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে'র পরে মুছে নেওয়া চোখ, তাও। সাদাকালো নয়, টেকনিকালারে সরে সরে যায় গানের ছবি।

'এই পথ যদি না শেষ হয়' শুনলে উত্তম-সুচিত্রা মনে পড়ে না আমার। মনে পড়ে গঙ্গার ওপর লঞ্চের পিকনিক। বাবার এক হাতে মাইক, অন্য হাত মায়ের কাঁধে, দরাজ গলায় 'এই পথ যদি না শেষ হয়' আর মাইকের কাছে মুখ এনে মায়ের 'তুমি বলো'। ঝলমলে উজ্জ্বল সব মুখ মনে পড়ে, হাততালির শব্দ মনে পড়ে, মায়ের লজ্জা, গর্ব, আহ্লাদ মেশানো হাসি, কাগজের প্লেটে ফিশ ফ্রাই, শেষ না হওয়া সেকেন্ড হুগলী ব্রিজ, শীতের নিরীহ গঙ্গা - দৃশ্যগুলো জলের মতোই আঙুল গলে পালায়।

বড় হয়ে যাই। ডানায় রঙ লাগে। চন্দ্রবিন্দু শিখি। বাবাকে বলি "একটা গান শুনবে?" রাজি হয়। নতুন পাওয়া ফিলিপস এর সিডি প্লেয়ার বলে 'বেখেয়ালে খুঁজে পাওয়া বই, ভালো আর থাকতে দিচ্ছে কই'। উত্তেজনা একটুও না লুকিয়ে বলি, "ভালো না?"

বেখেয়ালে গানগুলো ফিরে ফিরে আসে। টেনে আনে গল্পের ছবি। তেলা চুলে বেড়া বিনুনি বাঁধে লাল নিল ফিতেয়। একা হয়ে হেডফোন গুঁজি কানের ফুটোয়। জর্জ বিশ্বাস আজও সেই আগের মতোই গান - যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি, ঝড় এসেছে ওরে ওরে....দম চেপে ডুব দিই সুরে।

Saturday, September 27, 2014

প্রশ্নগুলো সহজ



খুব ছোটবেলা থেকেই খুব বেশি প্রশ্ন করার বাতিক। গঙ্গার জল বাড়েকমে কেন? রেডিওর ওপর যে বাচ্চা ছেলেটার মুখ, সেটা কে? বি এ টি এ বাটা – বাটা মানে কি? রাম নারায়ণ রাম কে? দাদুভাইএর মাথায় চুল নেই কেন? রুইতন মানে কি? ঐ চেনটা টানলে ট্রেন সত্যি থেমে যাবে? দূর্গা ঠাকুরের দশটা হাত কেন? বইয়ে পা লাগলে নমস্কার করতে হয় কেন? শুয়োর কি খায়? মরে গেলে কি হয়?

বড় হয়েও সে বাতিক ঘোচেনি। প্রশ্নের ধরণ হয়তো পাল্টেছে। কিন্তু বাতিকটা থেকেই গেছে। এক্সাইড থেকে মিত্র কাফে যাব কিকরে? মিউচুয়াল ফান্ডের রিডেম্পশন চেকে অ্যাকাউন্ট নাম্বার ভুল এসেছে, কি করব? ছায়াসূর্য সিনেমাটার ডিরেক্টরের নামটা কি যেন? শিয়ালদা ষ্টেশন টা আগে কেমন দেখতে ছিল, ফ্লাইওভার হওয়ার আগে? আচ্ছা সমরেশ বসু কি অক্ষয় গুন্ডাকে চিনতেন? তোমার কি মনে হয় না, এই বামফ্রন্টের কল্যাণেই আমাদের জুট ইন্ডাস্ট্রি লাটে উঠলো? জীবনের প্রথম ভোটটা কাকে দিয়েছিলে? আরে ঐ সিনেমাটার নামটা বলো না, ঐ যে গো, সুচিত্রা উত্তম কমল মিত্র মলিনা দেবী, একটা কুকুর ছিল, ঝুনু সোনা...আরে কিছুতেই মনে পড়ছে না।

প্রশ্নগুলো জমে যাচ্ছে রোজ। উত্তর পাচ্ছিনা।  

Wednesday, July 30, 2014

ভিসকি গোলি

টিভিটা ছিল চারপেয়ে। আর সামনে একটা শাটার যেটা দুদিকে খুলে যেত। তারপর নব ঘুরিয়ে চালু হত টিভি। আপট্রন। টিভিতে অ্যাড চললে নিথর হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়তাম। তখন অবশ্য অ্যাড বলা হত না, অ্যাভার্টাইসমেন্ট বলা হত। দুটো বিজ্ঞাপন ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় - 'নিরমা' আর 'ভিক্স'। এই দুটো জিঙ্গল গেয়ে দালান, উঠোন, বাগানে ঘুরে বেড়িয়েছি ঢের। নিরমার বিজ্ঞাপন টা আমি আর দিদিয়া অভিনয় করে সকলকে দেখাতেও পারতাম। ও ঘুরে ঘুরে দাঁড়াত আর আমি হামাগুড়ি দিয়ে ওর দু'পায়ের ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতাম 'ওয়াশিং পাউডার নিরমা' গাইতে গাইতে। বলাই বাহুল্য অভিনয়ের শেষে জোর করে হাততালিও জোগাড় করতাম।

আর ভিক্স এর বিজ্ঞাপনটায় তখন ছিল বাবা আর মেয়ে। বাবার পিঠে চড়ে মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ঘুরতে ঘুরতে বাবার গলা খুসখুস। অতঃপর আমিও বাবাকে ঘোড়া করে চড়ে বসতাম পিঠে। আর গলা ফাটিয়ে "ভিসকি গোলি লো খিচখিচ দুত কালো..." বলে ঘুরে বেড়াতাম একবার, দুবার, তিনবার, যতক্ষণ না বাবা 'আর নয়' বলছে।

ভিক্সটা এখনও মাঝেসাঝে খেতে বেশ ভালোই লাগে। বাবাকে অবশ্য দিই না। শুয়ে শুয়ে কি আর লজেন্স খাওয়া যায়?

Tuesday, July 29, 2014

সুকুমার সমগ্র

আমার ছ' বছরের জন্মদিনে বাবা একটা সুকুমার সমগ্র কিনে দিয়েছিল। মোটাসোটা শক্ত রংচঙে মলাট আর তার ওপর মস্ত অক্ষরে বই এর নাম। ততদিনে 'সুকুমার সমগ্র' কথাটা পড়তে পারি। মনে আছে বইটা হাতে পেয়ে প্রথমেই জিগ্যেস করেছিলাম, "সমগ্র মানে কি?" বাবা বলেছিল 'সব'। সত্যি কথা বলতে কি, বইটা হাতে পেয়ে খানিকটা গর্ব বোধ হলেও (অত মোটা বই পাওয়ায়) খুব যে উৎফুল্ল হয়েছিলাম এমন কিন্তু নয়। কারণ তখনও বই পড়ার অভ্যেস আমার তৈরি হয়নি। বই শোনার অভ্যেসটাই আমার সঙ্গে কল্পলোকের যোগসূত্র। বই শুনতাম ঠাকুমার কাছে রোজ রাতে শোবার আগে। 'সেভেন ইন্ডিয়ান ক্লাসিকস' থেকে বত্রিশ সিংহাসন, জাতকের গল্প, বেতাল পঞ্চবিংশতি, এইসব। তবে ছ' বছরের জন্মদিন আসার কয়েকমাস আগেই ঠাকুমা একদিন বাবা কাকা জেঠুদের কাঁধে চড়ে বেরিয়ে গেছেন। আর ফেরেননি।

অতএব সুকুমার সমগ্র পড়ে শোনানোর দায়িত্ব বাবার চওড়া কাঁধেই বর্তায়। সেবার পুজোয় যখন তিন ভাইবোন (আমি, ভাইয়া, দিদিয়া) একত্র হয়েছি আর তিনজনকে দুপুরে ঘুম পাড়ানোই সবচেয়ে দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাবা মাঠে নামলো, হাতে সুকুমার সমগ্র। ভারী গলায় পড়তে শুরু করল -

"বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের উপর রুমালটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্যে যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল "ম্যাও!" কি আপদ রুমালটা ম্যাও করে কেন?"

ব্যাস। তারপর থেকে দুপুরে বিছানায় যাওয়া নিয়ে কোনো বিদ্রোহ, হইচই কিচ্ছু নেই। খাওয়াদাওয়া সেরে নিজেরাই গুটিগুটি বিছানার পানে হাঁটা লাগাই, একবার বাবাকে তলব করে। আমার মনে আছে, ঐ সাজিমাটি আর কুলপি বরফের জায়গাটায় আমরা এক্কেবারে হিজি বিজ বিজ-এর স্টাইলেই হেসে কুটপাটি হয়েছিলাম। পুজোর ছুটির শেষ হবার পর, দিদিয়া-ভাইয়ারা চলে যাওয়ার পরেও অনেকগুলো রবিবার বাবার গলায় পাগলা দাশু্র সব গল্প, হিংসুটে, অবাক জলপান, শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি।

সুকুমার সমগ্র'টা পঁচিশ বছরের অত্যাচারে অনেকটাই জীর্ণ। এখন খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হয়। তবুও মাঝেসাঝেই নামিয়ে ফেলি তাক থেকে। তবে সেটা শুধুই সুকুমার রায়'এর মোহে নয়। তার কারণ এই একটাই মাত্র উপহারে বাবাকে আমি যে নামে ডাকি আর বাবা আমাকে যে নামে ডাকে, তার উল্লেখ আছে। বইটার প্রথম পাতায় বাবার হাতে লাল কালিতে লেখা একটা ছড়া-

"লক্ষীসোনা মারেম আমার
বয়স হলো ছয়
ভর্তি হলো ক্লাস ওয়ান এ
আর দেরী না সয়
মনটি দিয়ে লেখাপড়া
করতে হবে জেনো,
ভালোবাসবে সবাই তোমায়
কথা যদি শোনো।"
 - বাম্পি




Monday, July 28, 2014

তর্জনীর পৃথিবী

বাবার হাতটা খুব বড় ছিল। পুরো হাতটা ধরতে পারতাম না বলে, রাস্তায় বেরোবার সময় বাবা বাঁ হাতের তর্জনীটা বাড়িয়ে দিত। আর আমি সর্বশক্তি দিয়ে আমার ডান হাতের মুঠোয় চেপে ধরে রাখতাম ঐ একটা আঙুল। বাদামী রঙের, চওড়া, একটু খসখসে একটা আঙুল। পাড়ার গলিতে, পুরির সমুদ্রের ধারে, লীডার নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাবার সময়, স্কুল বাসে ওঠার ঠিক আগের মুহুর্ত পর্যন্ত ঐ একটা আঙুল ধরেই সবচেয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করেছি। মাইলের পর মাইল বছরের পর বছর। বাবা হাত ভাঁজ করলে বাইসেপ টা ফুলে উঠত। আর আমরা তখন বাবার হাতটা টিপে টিপে দেখতাম। লোহার মত শক্ত লাগত। ওয়েট লিফটিং করত তো, তাই গায়ে জোর ছিল ঢের। বাবার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি দেদার। অত উঁচু থেকে সবকিছু খুব নিচু লাগত। ভয়ও করত। বাবার মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরে থাকতাম। রামেস্বরমের মন্দিরের লাইনে দাঁড়িয়ে আমাকে তুলে উঁচু করে ধরেছিল যাতে বিগ্রহটা দেখতে পাই। দূরপাল্লার ট্রেনের ওপরের বার্থে উঠতে চাইলে এক ঝটকায় তুলে ওপরে বসিয়ে দিত। এক হাতে হোল্ডল, অন্য হাতে সুটকেস নিয়ে বাবা সবার আগে আর আমরা পেছনে পেছনে ছুটতাম ট্রেন ধরার সময়। লোকাল ট্রেনেও নাগালের বাইরের ঐ হ্যান্ডরেলেগুলো ছোঁবার আগ্রহ ছিল অসীম। ট্রেন ফাঁকা হয়ে এলেই তাই বাবার হাতে টান মেরে আঙুল দিয়ে ইশারায় টুক করে ইচ্ছেটা বুঝিয়ে দিতাম। আমাদের ষ্টেশন আসার আগেই ইচ্ছাপূরণ। তখন আর বড়দের সঙ্গে আমার কোনো ফারাক নেই। সবার মতো আমিও হ্যন্ডরেলে ভর। আর যেকোনো উঁচু জায়গা দেখলেই সেখানে উঠতে চাইতাম আর তারপরেই ওয়ান, টু, থ্রি...বলে ঝাঁপ; আর প্রত্যেকবার একইরকম তৎপরতায় বাবা খপ করে লুফে নিতেই বায়না - "আর একবার।"

এখন বাবার হাতটা খুব সরু হয়ে গেছে। আমার চেয়ে সরু। ইনজেকশন দিতে এসে কম্পাউন্ডার মাংস খুঁজে পায় না। এখন আমি গোটা হাতটাই ধরতে পারি অনায়াসে। নিজেরটা বাড়িয়ে দিই, যাতে সহজে উঠতে পারে বিছানা থেকে। এখনও শুয়ে থাকতে থাকতে নিজের হাতটা দ্যাখে বাবা মাঝে মাঝে। একদিন বললো "মাঝে মাঝে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করে। আমারই হাত তো?"