Monday, May 18, 2015

বাবার নাম নানা পটেকর

এই অবধি পড়ে যারা আমার বাবাকে ভারি মিষ্টি নরম সরম লোক ভেবে হিংসেয় কুপোকাত হয়েছেন, তাদের জন্যে আজ একটু অন্য কথা বলব। তখন আমার বয়ঃসন্ধি। বছর পনের বয়স। এবং প্রকৃতির নিয়ম অথবা পরিহাসে ক্রমশ বেশ গোলগাল হয়ে উঠছি। স্কুলের ইউনিফর্ম তখন স্কার্ট ব্লাউজ। বাড়ির গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হয় বাস আসার সময়ে। সেরকমই একদিন আমি আগে আর বাবা পিছনে হাঁটছে, বাসে তুলে দিয়ে আসতে। হঠাৎ ব্যঙ্গ শ্লেষ ধিক্কার মেশানো গলায় ভদ্রলোক বলে উঠলেন - "ছিঃ! হাতির মতো পা হয়েছে। তুমি আমার মেয়ে? এই চেহারার দশা? পরীক্ষা শেষ হলেই আমার সঙ্গে রোজ সকালে বেরবে।" নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না। বলেই ফেললাম, "আমি না তোমার মেয়ে? নিজের মেয়েকে এসব বলতে পারলে!" এবং আবার, "নিজের মেয়ে বলেই বলতে বাধ্য হলাম। অনেকদিন চোখ বুজে থেকেছি আর নয়।"

পরীক্ষা নিজের নিয়মেই শেষ হয়। আমারও হলো। দার্জিলিং পেলিং ঘুরেও আসা হলো। গুছিয়ে হ্যাম স্যান্ডউইচ পেঁদানোও হলো কেভেন্টার্সে। ট্যুরের সঙ্গেই রূপকথার সেইসব ফুরফুরে দিনও সাঙ্গ হলো এক সময়। তারপর শুরু হলো মেহনতি মানুষের লড়াই। সংগ্রাম বলাই ভালো।

বাবাকে দেখে তখন প্রহার সিনেমার নানা পটেকরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ভোর পাঁচটায় উঠে ট্র্যাক স্যুট পরিয়ে মাঠে কয়েক পাক দৌড়, থেমে গেলেই নিদারুণ তিরস্কার। তারপর গঙ্গার ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে ওঠানামা দশ দশ কুড়ি বার। তারপর ফ্রি হ্যান্ড। ওঠবোস করার সময় পিঠ সোজা না রাখতে পারার, হাঁটু ভেঙ্গে ফেলার, হাঁটুতে নাক ঠেকাতে না পারার অপরাধে নির্বিচার বকুনি। প্রথম দিনের পর মনে হচ্ছিল আমি কেপমারি চার্জে ধরা পড়ে কম্বল ধোলাই খাওয়া আসামী। হাঁটতে, চলতে, কমোডে বসতে, খাট থেকে নামতে, বাপের নয়, নিজের নাম ভোলার উপক্রম। তার ওপর খাঁড়ার ঘা, রবিবারের পাতে মাংস কম, রাতে খাওয়ার পরে মিষ্টি বাতিল...সর্বোপরি মরে যাওয়ার ইচ্ছে, এই বাড়িতে জন্মানোর জন্য ভাগ্যদেবীকে লিমিটলেস গালমন্দ। আমি নিশ্চিত জানি, নেহাৎ ওই লোকটার বৌ আমাকে রোজ খেতে দিত, আমার জন্য ভালোমন্দ রান্না করত তাই সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেছিলাম। নইলে নির্ঘাৎ ওই প্রহার সিনেমার মতোই দৌড় শেষ করতে না পারার অপরাধে ব্রেকফাস্ট নাকচ হয়ে যেত। ভাগ্যিস...
বিশ্বাস করুন, সেইসব দিনের স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মোটা হতে শুরু করি, তারপরেই ভয়ে ওঠবোস (প্রায় কান ধরেই) স্কিপিং সিটআপ করায় মনোনিবেশ করি। খালি মনে হয় আরেকটু মোটা হলেই লোকটা দেওয়ালের ছবি থেকে বলে উঠবে, "ছিঃ! তুমি না আমার মেয়ে! লজ্জা হওয়া উচিৎ।"

Saturday, February 21, 2015

এত শব্দ কেন!

কে যেন বলে গেছে, শব্দই ব্রহ্ম। কে বলেছে জানিনা। ব্রহ্ম কী তাও জানিনা। তবে মস্তিষ্কের কোনো এক কোণে যে তারা জমা হয়ে থাকে, সে বেশ টের পাই। বুকে কান পাতার অনুমতি পেলে চোখ বুঁজে শুনে নিই লাবডুব। সাজুগুজু হাই হিলের খটখট শুনে পার্ক স্ট্রিটে পিছু ফিরে তাকাই একটু হিংসে একটু বাহবা মেশানো দৃষ্টিতে। শিল কাটাও বুড়োটা পাথরে ছেনি ঘষে টুং টুং শব্দ তোলে বাড়ির উঠোনে। গরম তেলের কড়ায় মাছ ফেললেই রেগে ফুঁসে ওঠে কচ্চি ঘানি গলানো সোনারং তেল। ঠোঁট জিভ দাঁতেরা যখন খেলায় মাতে, তারাও শব্দ ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয় কানে। ফুচকাওয়ালা বুড়ো আঙুলে খচ করে ফুচকার শরীর ফুটো করে ভরে দেয় কাঁচা লংকা ধনেপাতা দিয়ে মাখা আলুর পুর। পাশের বাড়ির কাকু, বৌ মায়ের যৌথ রণক্ষেত্র ত্যাগ করে দুম করে বন্ধ করে ঘরের জানলা। শব্দ, শব্দের ভাষা দিয়ে ঘিরে রাখে মস্তিষ্কের কোণ, পরে ফিলার প্রোগ্রাম হিসেবে ব্যবহার করবে বলে।



সেদিন বেশ কুয়াশা জোর পোখরির চারপাশের পাইন বনে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে মাঝে মাঝে সাদা ধোঁয়ার মত কুয়াশা ছুঁয়ে যাচ্ছে মুখ। দূরে ওরা ছবি টবি তুলছে। একটু একটু করে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছি পাইনদের দিকে। হুল্লোড়ের শব্দ ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ পাহাড়ি গানের সুর। বোধহয় নেপালি ভাষায়। মেঘ কুয়াশার সঙ্গেই ভাসতে ভাসতে আদর করে গেল কানে। গানের লিরিকে কী ছিল কে জানে! এইসব সবুজের সম্মোহনের সামনে দাঁড়িয়ে অনায়াসে মরে যেতে চাওয়ার কথা? আবছা হয়ে হারিয়ে যাবার কথা?



ভক্তপুর দেখে ফিরছি। থেমেছি একটা বৌদ্ধ মন্দিরে। সামনে মচ্ছপুছারে আর অন্নপূর্ণায় বিকেল নামছে। হলুদ থেকে কমলা থেকে লাল থেকে গোলাপি থেকে হাল্কা বেগুনি রং ছুঁয়ে থেমে যাবার খেলা। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার পাশে একটা সিঁড়ি নেমে গিয়ে সুভেনিরের দোকানে চলে গেছে। দোকানটা খেয়াল করিনি আগে। ফিশটেইল দেখছি। চারপাশটা ফাঁকা হতে হতে আবছা হচ্ছে। হঠাৎ বজ্রগম্ভীর স্বরে, ভারি তিব্বতি ড্রামের তালে মন্ত্রোচ্চারণের আদলে ঔং মণিপদ্মে হুম বাজতে শুরু করল দোকানের ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে। ওই একটাই পদ, একই সুরে একই গাম্ভীর্যে ফিরে ফিরে ভাসতে লাগল সূর্যাস্তের পাহাড়ে। সেদিন সেখানে কেবল আমি, ফিশটেইল, অন্নপূর্ণা আর অস্তমিত সূর্যের ম্যাজিক! অক্ষরবৃত্তের বাইরে।
-------------------------------------------------------------------

ভাষা নিয়ে আজ আমার কিছু বলার নেই।

Tuesday, February 17, 2015

ঘুমের মধ্যে বাষ্পেরা

আমি মানুষটা এমনিতে খুব শরীর সর্বস্ব। ইন্দ্রিয়সর্বস্ব। চোখ কান জিভ ঠোঁট দিয়ে সর্বদা শুষে নিতে চাই চারপাশের ছোটখাটো পৃথিবীটাকে। সকালের রোদ, চায়ের কাপের ধোঁয়া, শাওয়ারের ফেনা ফেনা জল, সর্ষেবাটার ঝাঁঝ, লোহা টিন কাগজওয়ালার পাড়া কাঁপানো হাঁক, কবিতার অসুখী বিড়াল, ফাল্গুনের প্রেম, অ্যাশট্রেয় জমে থাকা পুরনো পোড়া ফিল্টারের কটু গন্ধ...সব। অথচ, আজকাল মানুষের গায়ের ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলি। ভালোবেসে কেউ হাতের রেখায় হাত রাখবে ভাবলে ভয় হয়। ভয় হয়, অন্য দেহের খাঁচার উত্তাপে প্রেসার কুকারের মত গুমোট চাপে বন্দী করে রাখা বাষ্পেরা জল হয়ে যাবে। বুকে মাথা রাখতে, চুলে বিলি কাটতে দিতে, পুষে রাখা কাটা দাগের পুঁজ রক্ত দেখাতে সাহস লাগে। বর্ম খুলে, শক্তির ছাল চামড়া খুলে দুর্বলতার কঙ্কালটুকু আরেক জোড়া চোখের সামনে মেলে ধরার মতো বুকের পাটা, মৃত্যু আমাকে দেয়নি।

তার চেয়ে সহজ নিজেকে ভেঙ্গে, টুকরোগুলো ছড়িয়ে দেওয়া রান্নাঘরে, চ্যাটের বাক্সে, ট্রেনের আড্ডায়, বিলিং সেকশনের লাইনে, ট্যাক্সির আধো অন্ধকার শরীর চেনার ঘেরাটোপে। দিনের শেষে ড্রেসিং টেবিলের লম্বাটে আয়নার সামনে বসে তুলোর বলে দুধসাদা ক্লিন্সিং মিল্ক লাগিয়ে তেল, কালি, হলুদ, লিপ্সটিক, কাজল মুছে নিতে নিতে চুপসে যাওয়া কালচে ধূসর তুলোর দিকে পরিতৃপ্তির দৃষ্টি বুলিয়ে নিতে নিতে আঁচল ভরে কুড়োতে থাকি ছড়িয়ে পড়া আমিগুলোকে। ফুটলাইটের হলদে আভাসে ঘুম আনতে আনতে পাশবালিশ আর আমার মধ্যে পড়ে ওরা মিশে যেতে থাকে চুলে, নখে, কানের লতিতে, কড়ে আঙুলের তিলে। 

ভোরের স্বপ্নে যারা আসে, তাদের সঙ্গে নির্ভয়ে করমর্দন করি।  

Friday, December 19, 2014

নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে...

পিঁক পিঁক পিঁক  করে যন্ত্রগুলো বেজে চলেছে ফিল্মি উদ্যমে। একগাদা ডিজিটাল মিটার আর তাতে অনেকগুলো সংখ্যা। কিছু সংখ্যার মানে বুঝি, কিছু গ্রিক। একটা মেশিনের মিটার তোমার 'রেস্পিরেশান' মাপছে। সেটায় মিটার ২১, ২০, ১৯ হতে হতে এখন ১৪ এ ঠেকেছে। আমি জানি ওটা আর বাড়বে না। কমতে কমতে এক সময়ে থেমে যাবে। হাসপাতালের এইচ ডি ওয়ার্ডের এসি টা বেশ জোর চলছে। তোমার গা খুব ঠান্ডা হয়ে গেছে। তোমার ডান হাতের তর্জনীটাও। আমি জানি তোমার চোখ খোলা হলেও তুমি আর আমাকে দেখতে পাচ্ছ না। তবুও তোমার মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দি। একবার ডাকি। বলা তো যায় না, যদি শুনতে পাও...যদি সাড়া দাও! সাড়া দাও না তুমি। দৃষ্টিহীন চোখে সামনের দেওয়ালের দিকে চেয়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকো ধীরে। আরো ধীরে। বুঝতে পারো না, সর্বশক্তি দিয়ে ধরে আছি তোমার ডান হাতের তর্জনীটা - যেটা ধরে এযাবৎকাল কাটিয়েছি। বুঝতে পারো না, তোমার বুকের ওঠাপড়ার দিকে কি অসীম আগ্রহে তাকিয়ে আছি। যন্ত্রের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এক সময় থেমে যাও। ঠান্ডা ঘরটায় তখন শুধু তুমি আর আমি। লড়াই শেষ করে নিশ্চিন্ত ঘুমের আশ্রয়ে তুমি। আর লড়াই শুরুর প্রস্তুতিপর্বে আমি।এক হাতে তোমার হাতটা ধরে থেকে অন্য হাতে তোমার চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে যখন তাকিয়ে আছি দুটো বন্ধ পলক আর অল্প ফাঁক হওয়া ঠোঁটের দিকে, হঠাৎ সেই গানটা মনে গেল, যেটা তুমি লোডশেডিং হলে গাইতে। সেই দুটো লাইন মনে মনে গুনগুন করতে থাকলাম - 

"জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর লোক-লোকান্তরে যুগ-যুগান্তর–
 তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে।"

তর্জনীর আশ্রয় ছেড়ে বেরলাম। সবাইকে খবরটা দিতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, কারুর হাত না ধরেই আমি দিব্যি চলতে পারি...।

Thursday, December 18, 2014

বড়দিন

ছোটবেলায় মিশনারি স্কুলে পড়তাম। তাই শীতের ছুটিটা হত লম্বা। তখন আমরা বেড়াতে যেতাম। কিন্তু বেড়াতে গিয়েও বড়দিনের দিনটায় ঘোরার সঙ্গেই জুড়ে যেত একটূ স্পেশাল খাওয়াদাওয়া। বেড়ানোর ডেস্টিনেশন কোনো শহর হলে, খুঁজেপেতে একটা কেক কিনে আনা হত। না পেলে, অন্য কোনো স্পেশাল মেনু। একবার বড়দিনের আমরা মাউন্ট আবু তে ছিলাম। হোটেলের বারান্দায় রোদে পিঠ ঠেকিয়ে জমিয়ে মাংস ভাত খাওয়া হয়েছিল মনে আছে। আর একবার ছিলাম কৌসানি তে। সেবার অবশ্য গান্ধী আশ্রমের ভেতরে থাকার কারণে আলাদা করে কোনো কেক টেকের ব্যবস্থা করা যায়নি। তবে সন্ধ্যেবেলা ঘরের মধ্যে কম্বলে গলা অব্দি ঢেকে গানের লড়াই খেলেছিলাম জমিয়ে। তারপর খাওয়ার ঘন্টা পড়লে গনগনে আগুনের আঁচে বসে গরম গরম ডাল রুটি সব্জি - আমার মত কট্টর আমিষাশীর কাছেও সেই খাবার ছিল অমৃত।

আর ছিল গ্রিটিং কার্ডের হুজুগ। স্কুলের গেটের বাইরে একটা লোক এক টাকা, দু টাকা, পাঁচ টাকার কার্ড নিয়ে বসত। আর থাকত সোনালী ছোট ছোট ঘন্টা, চকচকে রঙিন বল, নানারকমের রিবন, ছোট্ট সান্টা কলস...ক্রিস্টমাস ট্রি সাজাবার উপকরণ্লস্মায়ের কাছে পয়সা চেয়ে নিয়ে কার্ড কিনতাম। হিসেব করে। যার যার থেকে কার্ড পাবার আশা ছিল তাদের প্রত্যেকেই যাতে প্রয়োজনে রিটার্ন কার্ড দিতে পারি, হিসেবে যেন গন্ডগোল না হয়, সে ব্যপারে সতর্ক থাকতে হত। ছুটি পড়ার দিন আর ইউনিফর্ম নয়। রঙিন জামা পরে স্কুলে যাওয়া হত। ক্যারল গাইত গানের দল। আর মিত্র স্যার সান্টা সেজে ঝুলিতে লজেন্স ভরে হলের ভেতরে ঘুরতেন। মাঝে মাঝে থলিতে হাত ঢুকিয়ে এক মুঠো  লজেন্স তুলে এনে ছুঁড়ে দিতেন আমাদের মধ্যে হরির লুটের কায়দায়। সকলে ওমনি হামলে পড়তাম একটা বয়েজের অরেঞ্জ লজেন্স পাব বলে।

এখন তো কত বড় হয়ে গেছি, তাও ঐ ডিসেম্বরের পঁচিশ তারিখটা এলেই এক টুকরো প্লাম কেকের জন্য ফ্লুরিজ কি ক্যাথলিন কি মনজিনিস দৌড়ই। মনের মধ্যে ফরফর করে প্রজাপতি উড়তে থাকে। খালি মনে হয় কি যেন একটা করা উচিৎ। কিছু একটা না করলেই নয়। যীশুবাবার জন্মদিন বলে নয়, একটা গোটা শৈশব কৈশোরের অভ্যেস ধরে রাখব বলেই বোধহয়। আর পার্ক স্ট্রীটের বাৎসরিক আলোর মান রাখব বলে।

সেইসব পুরনো উলের গন্ধ

মনখারাপ বা বিষাদের কাছে মুখ রক্ষা করার দায় যাদের নেই, তারা শীতকাল পড়তে সহজেই তোরঙ্গ খোলে। বের করে ন্যাপথালিনের গন্ধ মাখা টুপি, মাফলার, শাল, যা আর কোনোদিন ব্যবহার হবে না, হবার নয়। ছাদে উঠে নিয়মমাফিক রোদে দেয় কাঁথা, লেপ, বালাপোশ। রাত পড়লে, বিছানার অন্য পাশটা খালি জেনেই, গোড়ালিতে ভেসলিন মেখে ঘুম দেয় রোদগন্ধ মাখা ঈষৎ গরম তুলোর আরামে। বন্ধ দরজা জানালার ওপাশে শীতের শুকনো হাওয়া তবুও খুব মাঝেসাঝে মাঝরাতে কাচ ঝনঝনিয়ে জানান দিয়ে যায়, বার্নিং ঘাটে যাদের রেখে আসা হয়, তারা আর ফেরে না। উত্তাপের প্রয়োজন তাদের ফুরিয়েছে।

দুর্গাপুজোর আগে

চার পেগ নির্ভেজাল ভদকা পাকস্থলিতে নিয়ে টলোমলো পায়ে মেট্রোয় উঠলো মেয়েটা| সুরেলা মেয়েলি গলা পরের স্টেশনের নাম জানিয়ে দেবার পরেই হঠাত মেট্রোর লাউডস্পিকারে গমগম করে উঠলো বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলার চন্ডিপাঠ| সুপ্রীতি ঘোষের গলা গেয়ে উঠলো বা-আ-আ-জ-লো-ও-ও তো-ও-ও-মা-আ-আ-আ-র আ-আ-আ-লো-র বেণু| মেট্রোর ভিড়, ঠেলাঠেলি ছাপিয়ে মনে পড়ে গেল মার্ফি রেডিও, নীল নাইলনের মশারি, কাকভোরে চায়ের কাপে চামচের টুংটাং আর বাবার হাতের ঠেলা "ওঠো ওঠো!" 

এই সামান্য প্ররোচনায় যে সব এত সহজে মনে পড়ে যাবে ভাবেনি শক্তপোক্ত মেয়েটা| ভেবেছিল যন্ত্রনারা ডুবে যায় কাঁচের গেলাসে, মাটির মালসা যেমন ডোবে গঙ্গায়| 

এক ট্রেন রঙিন লোকের মাঝে হঠাত কান্না পেলো সাধারণ মেয়েটার| নাক মুখ লাল করে দম চেপে ঢোঁক গেলে বানভাসি মেয়ে| মেট্রোর স্পিকারে চন্ডিপাঠ করতে করতে গলা ভেঙ্গে আসে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের|