Wednesday, October 29, 2014

দালোয়ান গায় গান শোনো ঐ লামা হই

এক বন্ধুর লেখায় কাল লাল পোস্টবক্স-এর কথা,  স্মৃতিগুলো সব উসকে দিল। লাল রংটা না, কেমন যেন। রাজনীতি নয়, স্মৃতির রং। লাল বললে পুরনো বাড়ির মেঝের কথা মনে পড়ে। চকচকে লাল ঠান্ডা মেঝে, যেখানে গরমকালের দুপুরে শুয়ে থাকতাম হাত পা ছড়িয়ে। যেখানে বাবা অফিস থেকে ফিরে গা ধুয়ে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে লম্বা হত, আর আমি বাবার পেটের ওপর বসে বকবকম করতাম।

নীল ষষ্ঠী, আশোক ষষ্ঠী, দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর আগে মা কাকিমা জেঠিমারা পা বাড়িয়ে বসে থাকত। আঙ্গুর পিসি পুরনো টুথব্রাশ দিয়ে আলতা পরিয়ে দিত ওদের পায়ে। বুড়ো আঙুলের পাশ দিয়ে নামত সরু লাল দাগটা, গোড়ালির কাছটা মোটা হয়ে ঘুরে গিয়ে আবার সরু হয়ে কড়ে আঙুল ছুঁয়ে, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে লাল রং করে দিত ব্রাশটা। উবু হয়ে বসে মন দিয়ে দেখতাম সেই ব্রাশের খেলা। আরেকদিন ঠাকুমার পায়ে কে যেন আলতা পরিয়েছিল। পায়ের চারপাশে নয়। গোটা পায়ে। তারপর একটা সাদা কাগজ চেপে ধরেছিল আলতামাখা পায়ে। কাগজে কি সুন্দর দুটো পায়ের ছাপ পড়ে গিয়েছিল। বাবা আমাকে কাগজের ওপর দাঁড় করিয়ে যেমন পেন্সিল দিয়ে পায়ের ছাপ এঁকে নিয়ে জুতোর দোকানে যেত, তেমনই। ঠাকুমার পায়ের সেই লাল ছাপ আজও ফ্রেমে বন্দি পুরনো বাড়ির দেওয়ালে।

ভাইয়াকে বাবা একটা প্লাস্টিকের গদা কিনে দিয়েছিল। সেটাও ছিল লাল রঙের। ওটা ঘাড়ে নিয়েই ও খাট, টুল, সিঁড়ি, রক থেকে ঝাঁপ দিত 'জয় শ্রী রাম' বলে। আর ছিল লাল আমার টোবু ট্রাইসাইকেলের সিট। সেই টোবু সাইকেল যাতে আমরা দুজন এমনকি তিনজনে মিলেও চেপে ঘুরে বেরিয়েছি ভাইয়াদের বিশাল জুটমিল কোয়ার্টারে। উত্তরাধিকার সূত্রে ও আমার কাছ থেকে পেয়েছিল সাইকেলটা। তারপর কার কাছে গেছিল ওটা, এখন আর তা মনে নেই। গান ছিল, ছড়াও ছিল টুকটুকে - "রবিমামা দেয় হামা গায়ে লাল জামা ঐ, দালোয়ান গায় গান শোনো ঐ লামা হই"। প্রথম কেনা কেলভিনেটর ফ্রিজ আর হারকিউলিস ক্যাপটেন লেডিস সাইকেলটাও কিকরে যেন সেই লাল রঙেরই কেনা হয়েছিল। আর হ্যাঁ, মায়ের শিল্পা টিপের পাতার প্রত্যেকটা টিপও ছিল টকটকে লাল।

এখন অবশ্য মা আর আলতা পরে না। কাকিমাও না।


Tuesday, October 21, 2014

প্রাক-ধনতেরাস যুগের সাদাকালো কথা



আজকে সেই প্রাক-ধনতেরাস যুগের কথা বলব, যখন বাঙালী কালীপূজো বলতে শুধু বাজি পোড়ানোই জানত। বাজির জমকও ছিল কম। ফুলঝুরি, রংমশাল, তুবড়ি, চরকি, হাউই, ছুঁচো বাজি, দোদোমা কালিপটকা, সাপবাজিই ছিল সম্বল। সোনার গয়না, রুপোর টাকা, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট ইত্যাদির কোনও ভূমিকা ছিল না। 

কালীপুজোর আগের কটা দিন মহা ব্যস্ততায় কাটত। বাবার সুপারভিশানে ছাদে খবরের কাগজ পেতে লাইন দিয়ে রোদে দেওয়া হত গোটা কুড়ি রংমশাল, পাঁচ-ছ প্যাকেট ফুলঝুরি, গোটা দশেক চরকি, তার বাজি, সাপবাজি, ব্যস। আর একটু বড় হতে তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল কালিপটকা আর বুড়িমার চকোলেট বোম। তবে কিনা বাজি রোদে দেওয়া তো আর সহজ কাজ নয়! রোদে দিয়ে রেগুলার ইন্টারভ্যালে সেগুলোকে উল্টে পাল্টে দিয়ে আসতে হবে। আর সেই সুযোগে বারবার বাজিগুলো হাতে নাড়াচাড়া করা যাবে আর মিলিয়ে নেওয়া যাবে স্টক। এই স্টক মেলানোর ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি, কারণ বাজি পোড়ানোর সময় কেউ এক্সট্রা বাজি ফাটিয়ে ফেললো কিনা, সেদিকে কড়া নজর রাখা দরকার। আর সেই জন্যেই স্টক মুখস্থ করা।
বাড়ির দোতলার বারান্দার বেশ খানিকটা অংশে তখন ছোটদের প্রবেশ নিষেধ, কারণ সেখানে আমাদের জ্যাঠতুতো দাদার কর্মযজ্ঞ চলছে। লোহাচুর, অ্যালুমিনিয়াম গুঁড়ো, গন্ধক, তুবড়ির খোল, রংমশালের খোল সার দিয়ে রাখা। রান্নাঘর থেকে শিলনোড়া হাইজ্যাক করায় একচোট হুলুস্থুল সকালে হয়ে গেছে। জিরে, আদা, রসূনের বদলে এখন তাতে গন্ধক বাটার কাজ চলছে। কাজ মিটে গেলে শিলনোড়া যারা ব্যবহার করে তাদের মধ্যেই একজনকে দায়িত্ব নিয়ে ওটা পরিস্কার করে পুরনো জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নাওয়া খাওয়া ভুলে তখন দাদার ওয়ার্কশপ চলছে। তুবড়ির উচ্চতাই পাড়ার মাঠে প্রেস্টিজ নির্ধারক মাপকাঠি। সবমিলিয়ে বাড়ির বাতাসে তখন বারুদের তুমুল গন্ধ। 

কালীপুজোর আগের দিন অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীর দিন সকালে চোদ্দ শাক খাওয়া আর রাতে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালা ছিল রুটিন। একটা থালায় চোদ্দটা ছোট ছোট মাটির প্রদীপ সর্ষের তেল, সলতে দিয়ে জ্বেলে বাড়ির বিভিন্ন কোণে বসিয়ে দিত মা বা কাকিমা, ভূত তাড়াতে। পরে বড় হয়ে অবশ্য মনে হয়েছে যে ও নেহাতই অর্থহীন একটা নিয়ম। যে বাড়িতে কাক চিল পড়ার অবস্থা ছিল না, সে বাড়িতে ভূত আসবে কোন সাহসে?
কালীপূজোর দিন সন্ধ্যেয় আসল পরীক্ষা। এক নম্বর পরীক্ষা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। বারান্দার আলসেয় সরু সরু মোমবাতির পেছনে আগুন দিয়ে বসানো তো হল। কিন্তু লাইনের শেষে পৌঁছতে না পৌঁছতেই শুরুর মোমবাতি নিবে যায়। আবার সেগুলো জ্বালাতে গেলে বাকিগুলো গন। শেষে হাল এবং কণ্ঠ দুইই ছেড়ে বাজি পোড়ানোয় মনোনিবেশ এবং যবনিকা পতন। 

এখনকার কালিপুজো-গুলোর জাঁক অনেক বেশি। 'মেড ইন চায়নার' আলোয় ছাদ-বারান্দা ঝলমলায়। অনেকরকমের বাজি আসে। আকাশে সাঁই করে উঠে গিয়ে মস্ত বড় ফুল হয়ে ঝরে পড়ে পাঁচশো টাকার নোট। প্যারাশ্যুট নামে, আলোর মালা ভাসে আকাশে। কিন্তু আর যাই হোক দোকানের কেনা তুবড়ি দাদার তুবড়িকে টেক্কা দিতে পারে না আজও। ফুস করে জ্বলে উঠে নিবে যায়। 

আর কেন জানিনা, ভাইবোনেরা সেই ছোটবেলার ফুলঝুরি চরকির গল্পেই ঘুরেফিরে চলে আসি বারবার। দাদার হাতে রংমশাল ফেটে যাওয়ার গল্পে, কাকার পেছনে চরকি তাড়া করার গল্পে, দাঁত পড়ে রসগোল্লায় গেঁথে যাওয়ার গল্পে। বারুদের গন্ধমাখা লালনীল আলোয় বোধহয় মাদকতা আছে।   


পুনশ্চঃ তখন বারুদের গন্ধ বললে বাজি পোড়ানোর কথাই মাথায় আসত।

Tuesday, October 14, 2014

আমার গানের স্বরলিপি

এক একটা গানের গায়ে এক একটা নাম লেখা থাকে। সময় লেখা থাকে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন লেখা থাকে। এক একটা গান যেন টাইম মেশিনের এক একটা চাকা। ওদের গায়ে ভ্যাপসা গন্ধ হয় না। পোকায় কাটে না। ভাঁজ পড়ে না অবাঞ্ছিত।

মাখনের মতো হেমন্তের গলায় 'কোনো এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো রূপকথা নয় সে নয়...' শুনলেই আজও সেই লাল মেঝে, কালো বাক্সের মতো ন্যাশনাল প্যানাসনিক টেপ রেকর্ডার, কালো কাঠের আলনা, কড়িকাঠ, কুলুঙ্গি এসব মনে পড়ে যায়। টেপ জড়িয়ে গেলে আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছাড়ানো মনে পড়ে, লোডশেডিং হলে রকে বসে বাবার গলার 'রানার ছুটেছে খবরের বোঝা হাতে রানার রানার চলেছে রানার' মনে পড়ে। অন্ধকার পাইনের বনের ধারে দাঁড়িয়ে বলা "বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা টা একবার গাও না প্লিজ" মনে পড়ে। স্থায়ী অন্তরা গুলিয়ে যাওয়া মনে পড়ে। 'আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে'র পরে মুছে নেওয়া চোখ, তাও। সাদাকালো নয়, টেকনিকালারে সরে সরে যায় গানের ছবি।

'এই পথ যদি না শেষ হয়' শুনলে উত্তম-সুচিত্রা মনে পড়ে না আমার। মনে পড়ে গঙ্গার ওপর লঞ্চের পিকনিক। বাবার এক হাতে মাইক, অন্য হাত মায়ের কাঁধে, দরাজ গলায় 'এই পথ যদি না শেষ হয়' আর মাইকের কাছে মুখ এনে মায়ের 'তুমি বলো'। ঝলমলে উজ্জ্বল সব মুখ মনে পড়ে, হাততালির শব্দ মনে পড়ে, মায়ের লজ্জা, গর্ব, আহ্লাদ মেশানো হাসি, কাগজের প্লেটে ফিশ ফ্রাই, শেষ না হওয়া সেকেন্ড হুগলী ব্রিজ, শীতের নিরীহ গঙ্গা - দৃশ্যগুলো জলের মতোই আঙুল গলে পালায়।

বড় হয়ে যাই। ডানায় রঙ লাগে। চন্দ্রবিন্দু শিখি। বাবাকে বলি "একটা গান শুনবে?" রাজি হয়। নতুন পাওয়া ফিলিপস এর সিডি প্লেয়ার বলে 'বেখেয়ালে খুঁজে পাওয়া বই, ভালো আর থাকতে দিচ্ছে কই'। উত্তেজনা একটুও না লুকিয়ে বলি, "ভালো না?"

বেখেয়ালে গানগুলো ফিরে ফিরে আসে। টেনে আনে গল্পের ছবি। তেলা চুলে বেড়া বিনুনি বাঁধে লাল নিল ফিতেয়। একা হয়ে হেডফোন গুঁজি কানের ফুটোয়। জর্জ বিশ্বাস আজও সেই আগের মতোই গান - যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি, ঝড় এসেছে ওরে ওরে....দম চেপে ডুব দিই সুরে।